আমি বসে বসে রিমির জন্য অপেক্ষা করছি। এমন সময় বন্ধুরা হুরমুর করে ঘরে ঢুকলো। তারিফ হন্তদন্ত হয়ে বললো,
.
-- দোস্ত, রিমি পালিয়ে গেছে। (তারিফ)
.
তারিফের কথা শুনে আমি এক প্রকার লাফিয়ে উঠলাম। রিমি পালিয়ে গেছে মানে.? আমি চোখ বড় বড় করে বন্ধুদের দিকে চেয়ে আছি। ওরা কি আমার সাথে প্র্যাঙ্ক করছে নাকি.? আমি কিছু বলার আগে তারিফ আবার বলে উঠলো,
.
-- রিমিকে কনে সাজানোর জন্য ওর বান্ধবীরা পার্লারে নিয়ে গেছিল। কিন্তু এখন ওরা এসে বলছে রিমি সেখান থেকে পালিয়ে গেছে। কোথায় গেছে কেউ জানে না। ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছে। (তারিফ)
.
তারিফের সব কথা আমার মাথার উপর দিয়ে গেল। কিছুই মাথায় ঢুকছে না। আমি আশ্চর্যে আশ্চর্যন্বিত হয়ে গেছি। এটা কিভাবে সম্ভব.?
রিমি আমাকে বিয়ে করার জন্য এতসব কান্ড ঘটালো। আর এখন সে বিয়ে না করেই পালিয়ে গেল.? আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না। নাকি এটা রিমির নতুন কোনো প্ল্যান.? কি হচ্ছে এসব.? সবকিছু কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। রিমি কোথায় পালিয়ে গেল.?
আমার চুপ থাকা দেখে আশিক শান্তনা দিয়ে বললো,
.
-- চিন্তা করিস না। আমরা রিমিকে খোঁজার জন্য লোক লাগিয়েছি। খুব তাড়াতাড়ি রিমিকে পেয়ে যাবো। (আশিক)
.
আশিকের কথা আমি এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিলাম। আমার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে। রিমি পালালো কেন.? সে তো পালিয়ে যাওয়ার মত মেয়ে নয়। নিশ্চয় কোনো মতলব এঁটেছে শয়তান্নীটা। আমাকে আবার নতুন করে ফাসানোর প্ল্যান করেছে।
আমি কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থেকে বন্ধুদের চলে যেতে বললাম। একটু একা থাকতে চাই। কেউ যেন বিরক্ত না করে।
.
আমার কথামত সবাই চলে গেল। আমি বসে বসে রিমির কথা চিন্তা করছি। মেয়েটা আমাকে চিন্তায় ফেলে গেল কোথায়.?
মিনিট দ'শেক পর রিমির বান্ধবীরা একজোট হয়ে রুমে প্রবেশ করলো। আমি মাথা তুলে তাদের পানে চাইলাম। সানজিদা মুখ ভার করে বললো,
.
-- শাহিন ভাই, আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি রিমি পালিয়ে যাবে। সত্যি বলতে আমাদের কারোর-ই এটা বিশ্বাস হচ্ছে না। (সানজিদা)
.
-- বিশ্বাস তো আমারও হচ্ছে না। আচ্ছা, তোমরা আবার শয়তানি করছো না তো.? (আমি)
.
-- আল্লাহ কসম করে বলছি, রিমি সত্যি-ই পালিয়েছে। আমরা রিমিকে পার্লারে নিয়ে গিয়ে সাজাচ্ছিলাম। হটাৎ রিমির ফোন বেঁজে উঠে। সে আমাদের বললো জরুরি ফোন। তারপর ফোনে কথা বলতে বলতে বাইরে চলে গেল। তখন থেকেই রিমির কোনো হদিস নেই। ফোনটাও বন্ধ। (সানজিদা)
.
-- আমার তো মনে হচ্ছে রিমির এটা নতুন কোনো প্ল্যান। ওকে আমি হারে হারে চিনি। (আমি)
.
-- না, শাহিন ভাই। এবার আর রিমি কোনো প্ল্যান করেনি। সে সত্যি সত্যি চলে গেছে। আপনার থেকে অনেক দূরে। যাতে রিমিকে আপনার বিয়ে করতে না হয়। (সানজিদা)
.
-- তোমরা এত সিওর হয়ে বলছো কিভাবে.? (আমি)
.
সানজিদা মুখে কিছু বললো না। হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটা চিরকুট বের করে দিলো। আমি চিরকুটটা নিলাম। সানজিদা জড়ানো গলায় বললো,
.
-- চিরকুটটা রিমির ব্যাগ থেকে পেয়েছি। রিমি এটা আপনাকে দিতে বলেছে। চিরকুটটা পড়লেই আপনি সব বুঝতে পারবেন। (সানজিদা)
.
তারপর সানজিদা'সহ রিমির সব বান্ধবীরা চলে যেতে লাগলো। সানজিদা দরজার কাছে গিয়ে আবার ফিরে তাকালো। কান্নাভেজা গলায় বললো,
.
-- রিমি আপনাকে সত্যি-ই অনেক ভালোবাসতো, শাহিন ভাই। শুধুমাত্র আপনার সুখের জন্য সে চলে গেছে। আপসোস শুধু একটাই, আপনি রিমির খাঁটি ভালোবাসাটা বুঝলেন না। (সানজিদা)
.
সানজিদার কথার উত্তরে কিছু বললাম না। অবাক হয়ে সব কথা শুনলাম। সানজিদা চোখের কোণে জমে থাকা জল মুছে চলে গেল। আমি হাতে থাকা চিরকুটের দিকে তাকালাম। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কি যেন ভেবে চিরকুটের ভাঁজ খুললাম। তারপর পড়া শুরু করলাম,
.
তোকে আজ কি বলে সম্মোধন করবো ভেবে পাচ্ছি না। কারণ 'প্রিয়' বলার অধিকার অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছি। তুই হয়তো ভাবছিস আমি কোনো নতুন মতলবে চলে গেছি।। এমনটা ভাবাই স্বাভাবিক। কিন্তু এবার আমি তোকে ফাঁসাতে বা অন্যকিছু করার জন্য চলে যায় নি। আমি চলে গেছি কারণ তুই যেন আমার ভালোবাসা বুঝতে পারিস। একটা কথা কি জানিস, ভালোবাসার মানুষ কাছে থাকলে তার গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায় না। কিন্তু সেই ভালোবাসার মানুষটাই যখন হুট করে দূরে চলে যায়, তখন তার মূল্য বোঝা যায়। বোঝা যায় সেই মানুষ জীবনের কতটা জায়গা জুড়ে ছিল।
ভেবেছিলাম তোর বউ হবো। কিন্তু আমি তোর বোঝা হয়ে থাকতে চাইনা। তোর সাথে আজ বিয়ে হলে সারাটা জীবন তুই আফসোস করে কাটাতি। আমি তোর জীবন নষ্ট করে দিয়ে দিয়েছি এমনটা বলতি। ভালোবাসার বদলে আমাকে করুণা করতি। যা আমি কখনোই চাইনি। তাই চলে যাচ্ছি। আমাকে খোঁজার চেষ্টা করিস না। যেদিন তোর মনে আমার জন্য সামান্যতম হলেও অনুভূতির সৃষ্টি হবে, সেদিন আমি ফিরে আসবো। ততদিন আমার অপেক্ষা করিস। আর এতদিন তোর সাথে যা-যা করেছি সেসবের জন্য ক্ষমা করে দিস। আমি শুধু তোর ভালোবাসা পাওয়ার জন্যই এসব করেছি। কিন্তু না বুঝে তোকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।
আমি ভেবেছিলাম জোর করে তোর ভালোবাসা আদায় করে নিবো। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। ভালোবাসা কখনো জোর করে পাওয়া যায় না। ভালোবাসা হচ্ছে সাধনা। অনেক কষ্ট করে সেই সাধনাকে অর্জন করতে হয়।
তবে একটা কথা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, তুই ও আমাকে ভালোবাসিস। শুধু সেটা উপলব্ধি করতে পারছিস না। কিন্তু যেদিন উপলব্ধি করতে পারবি সেদিন অনেক দেরি হয়ে যাবে। আমাকে শত চেষ্টা করেও খুঁজে পাবি না।
ভালো থাকিস ও নিজের যত্ন নিস। আর পারলে আমার অপেক্ষায় থাকিস। আমি ফিরে আসবো।
ইতি তোর জীবনের সবচেয়ে বড় কাটা,
রিমি...
.
এক নিঃশ্বাসে চিঠিটা পড়ে শেষ করলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, রিমির এত কষ্টের কথা জেনেও আমার একটুও খারাপ লাগলো না। বরং মনে মনে প্রচন্ড খুশি হলাম। এতদিনে আপদটা বিদেয় হয়েছে। রিমিকে আর বিয়ে করতে হবে না। আমি প্রশান্তির শ্বাস ছেড়ে শুয়ে পড়লাম। অনেকদিন ধরে শান্তির ঘুম ঘুমায় নি। আজ একটু শান্তিতে ঘুমাবো।
.
.
.
৫ বছর পর........
.
শুক্রবারে অফিস বন্ধ তাই বেলা করে ঘুমাচ্ছিলাম। ঘুম ভাঙলো মায়ের চিল্লাচিল্লিতে। আমি বিরক্ত হয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে বললাম,
.
-- সকাল সকাল ডাকছো কেন.? কি হয়েছে.? (আমি)
.
-- তাড়াতাড়ি উঠে বাজারে যা। বাড়িতে মেহমান আসবে। (মা)
.
-- শুক্রবারের দিনটাতেও কি একটু শান্তিমত ঘুমাতে দিবে না.? বাবাকে যেতে বলো। (আমি)
.
-- তোর বাবা মেহমানদের আনতে গেছে। তোকে বাজারে যাওয়ার জন্য বলে গেছে। (মা)
.
-- পারবো না। অন্য কাউকে পাঠাও। (আমি)
.
-- তুই যাবি নাকি আমি ঝাড়ুটা নিয়ে আসবো.? (মা)
.
মা'র কথা শুনে লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলাম। সকাল সকাল ঝাটার বাড়ি খাওয়ার ইচ্ছা নেই। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাসিমুখে বললাম,
.
-- কি কি আনতে হবে লিস্ট করে দাও। (আমি)
.
-- লিস্ট করাই আছে। এই নে। (মা)
.
মা আমার হাতে ইয়া লম্বা একটা বাজারের লিস্ট ধরিয়ে দিলো। আমি চোখ কপালে তুলে বললাম,
.
-- এত্তগুলো জিনিস আনতে হবে.? (আমি)
.
-- হুম, একটাও যেন বাদ না যায়। (মা)
.
-- বাড়িতে মেহমান আসবে নাকি হাতির পাল আসবে বুঝতে পারছি না। ১ দিনেই যদি এতগুলো বাজার লাগে, তাহলে ফকির হতে বেশি দেরি নেই। (আমি)
.
-- চুপ কর তো। বেশি বকবক না করে বাজারে যা। (মা)
.
-- না গিয়ে তো আর উপায় নেই। তা কে মেহমান আসছে.? (আমি)
.
-- আসলেই দেখতে পাবি। (মা)
.
আমি আর কথা বাড়ালাম না। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে বাজারের উদ্দ্যেশে রওনা হলাম।
কিন্তু মা'র লিস্ট অনুযায়ী বাজার করতে করতে মামলা খারিজ। সারা বাজার ঘুরতে হয়েছে।
বাজার করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় জু'মার নামাজের সময় হয়ে এলো। আমি বাজারের ব্যাগ রেখে গোসল সেড়ে নামাজ পড়তে গেলাম। নামাজ শেষে মোনাজাতে আমি শুধু রিমিকে চাইলাম। আল্লাহ যেন ওকে আবার আমার জীবনে ফিরিয়ে দেয়। গত ৫ বছর ধরে আল্লাহর কাছে আমি শুধু এই দোয়াটায় করছি। কিন্তু আজ আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করবে ভাবিনি।
.
আমি নামাজ শেষ করে বাড়িতে এসে ঘরে ঢুকতে যাবো, এমন সময় পাশের ঘর থেকে একটা মেয়ের গলার আওয়াজ ভেসে এলো। আমি কান খাড়া করে শুনতেই চমকে উঠলাম। এটা তো রিমির গলা। এত বছর পরও রিমির গলার স্বর চিনতে আমার বিন্দুমাত্র ভুল হয়নি। কিন্তু রিমি আমাদের বাড়িতে কি করছে.? সে তো লন্ডনে চলে গিয়েছিল। নাকি আমি ঘোরের মর্ধ্যে রিমির গলার আওয়াজ পাচ্ছি.?
.
আমি সিওর হওয়ার জন্য পাশের ঘরে উঁকি দিলাম। রিমি সোফায় বসে মা'র সাথে গল্প করছে। আমার চোখ ফুটবলের আকার ধারণ করলো। নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আমি স্বপ্নে দেখছি। নিজেই নিজেকে একবার চিমটি কেটে পরখ করে দেখলাম। না, স্বপ্ন নয়; সত্যি-ই এটা রিমি।
.
আজ প্রায় ৫ বছর পর রিমিকে দেখলাম। অনেকটাই বদলে গেছে সে। তবে চেহেরায় বাচ্চা বাচ্চা ভাবটা আছেই। আমি হাসিমুখে ঘরে ঢুকলাম। কিন্তু হাসিটা বেশিক্ষণ টিকলো না। রিমির পাশে সুদর্শন একটা ছেলেকে দেখে আমার বুকটা ছ্যাত করে উঠলো। হাসিমুখটা মলিন হয়ে গেল। রিমির পাশে এই ছেলেটা কে.? রিমির স্বামী নাকি.? একদম গাঁ ঘেষে বসে আছে। রিমি আমাকে অপেক্ষা করতে বলে নিজেই বিয়ে করে ফেলেছে।
.
চলবে....... ????????
.