আজ প্রায় ৫ বছর পর রিমিকে দেখলাম। অনেকটাই বদলে গেছে সে। তবে চেহেরায় বাচ্চা বাচ্চা ভাবটা আছেই। আমি হাসিমুখে ঘরে ঢুকলাম। কিন্তু হাসিটা বেশিক্ষণ টিকলো না। রিমির পাশে সুদর্শন একটা ছেলেকে দেখে আমার বুকটা ছ্যাত করে উঠলো। হাসি মুখটা মলিন হয়ে গেল। রিমির পাশে এই ছেলেটা কে.? রিমির স্বামী নাকি.? একদম গাঁ ঘেষে বসে আছে। রিমি আমাকে অপেক্ষা করতে বলে নিজেই বিয়ে করে ফেলেছে।
.
আমার বুকটা চিনচিন করে ব্যথা করতে লাগলো। যাকে এত ভালোবাসলাম, যার জন্য এতদিন অপেক্ষা করলাম; সে আজ অন্যকারো হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা যেই রিমি নামের মেয়েটা আমাকে ভালোবাসা শেখালো সেই রিমি এখন আমার নেই। সবসময় ভাবতাম রিমি যেদিন ফিরবে সেদিন মস্ত বড় সারপ্রাইজ দিবে। কথা সত্য, রিমি সারপ্রাইজ দিয়েছে। কিন্তু সেই সারপ্রাইজটা আমার কাছে মৃত্যু যন্ত্রণার সমান মনে হচ্ছে। আমি সহ্য করতে পারছি না। রিমির পাশে ছেলেটাকে দেখে আমার শরীর দাউ-দাউ করে জ্বলছে।
.
আমি মুখ কালো করে দরজার এক কোণে দাঁড়িয়ে আছি। মা, রিমি এবং সুদর্শন চেহেরার ছেলেটা গল্প করতে এতটাই ব্যন্ত যে আমাকে খেয়াল পর্যন্ত করেনি।
আমি তাদের ধ্যান ভাঙার জন্য জোরে একটা কাশি দিলাম। কাশির শব্দ শুনে সবাই আমার দিকে তাকালো। মা হাসিমুখে বললো,
.
-- এতক্ষণ কোথায় ছিলি.? দেখ কে এসেছে.! (মা)
.
আমি এবার সরাসরি রিমির দিকে তাকালাম। রিমিও আমার দিকে তাকালো। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণের জন্য নয়। আমার দিকে আড় চোখে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। এমন একটা ভাব দেখালো যেন আমাকে চিনেই না। খুব খারাপ লাগলো আমার। বিদেশে গিয়ে অনেক বদলে গেছে রিমি। আগের মত আমাকে কাছে পাওয়ার পাগলামি রিমির মাঝে নেই।
.
আগে যখন রিমি আমাদের বাড়িতে থাকতো তখন সে কোথায় যেতে চাইতো না। মামা অনেকবার ওকে নিতে এসেছে। কিন্তু সে যায়নি। আর গেলেও ১-২ দিন থেকে আবার আমাদের বাড়িতে চলে এসেছে। তারপর আমার সাথে দুষ্টুমি, ঝগড়া, খুনশুটি শুরু করে দিত। তাছাড়া প্রচন্ড কেয়ার করতো আমার। রিমি আমাকে প্রায় বলতো, 'তোকে ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছা করেনা।' আমি কারণ জানতে চাইলে রিমি বলেছিল, 'তোকে ছেড়ে কোথাও গেলে মনে হয় আমার সাথে আমার প্রাণটা নেই। তুই হচ্ছিস আমার প্রাণ.!'
.
অথচ রিমির সাথে আমার ৫ বছর পর দেখা হলো। কতকিছু ভেবে রেখেছিলাম এই দিনটা নিয়ে। কিন্তু রিমি আমাকে চিনতেই পারছে না। এতদিন পর দেখা হলো, অথচ একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না আমি কেমন আছি। রিমির এমন পরিবর্তন আমি মেনে নিতে পারছি না। অনেকে বলে, 'দূরত্ব বাড়লে ভালোবাসা কমে যায়।'
আমি এটা কখনো বিশ্বাস করতাম না। এমনকি রিমি চলে যাওয়ার পর যখন তাকে ভালোবাসতে শুরু করলাম, তখনও আশেপাশের লোকজন অনেক কিছু বলেছে। রিমি আমাকে ভুলে যাবে, আমার প্রতি তার ভালোবাসাটা বেশিদিন থাকবে না, বিদেশে সেটেল হয়ে যাবে- আরো অনেক কিছু। আমি সেসব কথা কানে তুলতাম না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তারাই ঠিক বলেছিল। রিমি সত্যি-ই আমাকে ভুলে গেছে।
.
-- ছেলেটা কে আন্টি.? (ছেলেটা)
.
সুদর্শন দেখতে ছেলেটা আমাকে ইশারা করে মাকে প্রশ্ন করলো। আমি তড়িঘড়ি করে চোখের জল মুছে একটু হাসার চেষ্টা করলাম। রিমির কথা ভাবতে ভাবতে চোখে জল চলে এসেছিল। ভাগ্যিস কেউ দেখেনি।
মা আমাকে দেখিয়ে মিষ্টি হেসে বললো,
.
-- আরে ওকে চিনতে পারোনি.? ও শাহিন, আমার ছেলে.! (মা)
.
-- আরেব্বাস.! তুমি-ই তাহলে সেই শাহিন.? যাক অবশেষে দেখা হলো। অনেক সাধ ছিল তোমাকে দেখার। ইচ্ছেটা পূরণ হলো। (ছেলেটা)
.
-- আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না। কে আপনি.? (আমি)
.
সোজাসুজি প্রশ্ন করলাম ছেলেটাকে। জানা দরকার সে আসলে কে। রিমির কোনো আত্মীয় বলে তো মনে হচ্ছে না। নাকি আমার ধারণাটাই ঠিক। ছেলেটা রিমি স্বামী.!
আমি আর কিছু ভাবতে পারলাম না। উত্তরের আশায় ছেলেটার দিকে চেয়ে রইলাম। ছেলেটা মৃদু হেসে বললো,
.
-- আমি কে সেটা তোমার না জানলেও চলবে। তবে তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী ভাবতে পারো। (ছেলেটা)
.
-- সেটা না হয় ভাবলাম। কিন্তু আপনার নামটা তো বলতে পারেন। (ভ্রু-কুঁচকে)
.
-- আমার নাম শরীফ। আমি রিমির....???? (ছেলেটা)
.
-- মা, আমার একটু কাজ আছে। আমি গেলাম। (আমি)
.
'শরিফ' নামক ছেলেটাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম আমি। এখানে আর থাকতে মন চাচ্ছে না। কিন্তু মা বাঁধা দিয়ে বললো,
.
-- ছুটির দিনে আবার কিসের কাজ.? বস এখানে। (মা)
.
-- সময় নেই মা। স্যার অনেক্ষণ ধরে ফোন দিচ্ছে। নতুন একটা প্রজেক্ট হাতে পেয়েছে। সেটা নিয়ে আলোচনা করবে। আমি আমার ঘরে যাচ্ছি। বিরক্ত না করলে খুশি হবো। (আমি)
.
-- কতদিন পর রিমি এসেছে আর তুই কাজের বাহানা দিয়ে চলে যাচ্ছিস। (মা)
.
-- তাহলে কি করতে বলছো.? রিমি এসেছে বলে এখন ধৈ-ধৈ করে নাচতে হবে নাকি.? (রেগে)
.
-- আমি সেটা কখন বললাম.? আরে রিমির সাথে একটু গল্প তো করতে পারিস। ওর ভালো লাগবে। (মা)
.
-- বললাম তো সময় নেই। তাছাড়া রিমির গল্প করার লোকের অভাব আছে নাকি.? গল্প করার লোক তো সাথে করে নিয়েই এসেছে। (আমি)
.
কথাগুলো আমি 'শরীফ' নামক ছেলেটার উদ্দেশ্যে বললাম। কিন্তু সে আমার কথা বুঝতে পেরেছে কি-না জানিনা। তবে সে সামান্য হাসলো। এই হাসি দ্বারা সে কি বোঝালো মাথায় ঢুকলো না।
আমি আর কিছু না বলে ঘরে চলে এলাম। আসার আগে রিমির দিকে একবার তাকিয়েছিলাম। মাথা নিচু করে ফোন টিপছিল। যেন আমার কথা সে শুনতেই পায়নি।
.
ঘরে এসে শুয়ে শুয়ে আমি রিমির কথা ভাবতে লাগলাম। আজ পুরোনো দিনের কথাগুলো খুব মনে পড়ছে। পুরোনো রিমিকে বড্ড মিস করছি। সেই রিমি ও আজকের রিমির মাঝে আকাশ-পাতাল তফাৎ।
সবচেয়ে বড় কথা, আমি পুরোনো রিমিকে ভালোবেসেছি, আজকের এই নতুন রিমিকে আমার ঘৃণা হচ্ছে।
.
৫ বছর আগে যখন রিমি চলে গিয়েছিল তখন প্রথম প্রথম সবকিছু ঠিকঠাক ভাবেই চলছিল। মোট কথা, রিমি চলে যাওয়ায় আমার জীবনে বিন্দুমাত্র ফারাক পড়েনি। বরং আমি খুশি ছিলাম। মনে হচ্ছিল আমি স্বাধীন.! যা মনে চাইতো তাই করতাম। কারণ বাধা দেওয়া বা শাসন করার মত কেউ ছিলনা। লাইফটাকে নতুন ভাবে ইনজয় করা শুরু করলাম। রিমি কোথায় আছে, কি করছে, বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে- সেসব নিয়ে আমার মাথাব্যথা ছিলনা। আমি আমার লাইফ নিয়ে বিন্দাস ছিলাম।
.
কিন্তু এত আনন্দ আমার লাইফে খুব বেশিদিন স্থায়ী হলোনা। ২-৩ মাস যাওয়ার পর সবকিছু কেমন যেন ফিকে হয়ে গেল। সব থেকেও যেন কিছুই নেই। সবসময় আমার মন রিমিকে খুজে বেড়ায়। না চাইতেও রিমি আমার কল্পনায় চলে আসে।
এভাবে আরো ৩-৪ মাস কেটে যায়। আমার অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে।
.
রিমির জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠে। তাকে একনজর দেখার সাধ জাগে। আমি রিমির খোজ নেওয়া শুরু করি। জানতে পারি রিমি লন্ডনে আছে। সেখানে এক দূরসম্পর্কের খালার বাড়ি থেকে রিমি পড়াশোনা করছে। অনেক কষ্টে সেখানকার ফোন নাম্বার জোগাড় করি। তারপর একরাশ আশা নিয়ে রিমিকে ফোন করি। কিন্তু রিমি আমার কন্ঠ শুনে ফোন কেটে দেয়। তারপর আর যোগাযোগ করার সুযোগ পাইনি। আসলে রিমি চায়নি আমি তার সাথে যোগাযোগ করি। তাই যোগাযোগ করার সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল।
.
এদিকে,
রিমিকে ছাড়া আমার অবস্থা শোচনীয়। কিছুই ভালো লাগে না রিমিকে ছাড়া। এমন মনে হয় আমি পাগল হয়ে যাবো। এভাবে দেখতে দেখতে ১ বছর কেটে গেল। এই ১ বছরে আমি হারে হারে টের পাই রিমি আমার জীবনে কতটা জায়গা জুড়ে ছিল।
.
এখন আর কেউ আমার জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করেনা, দেরি করে বাড়ি ফিরলে কাউকে কৈফিয়ত দিতে হয়না, সিগারেট খেলে বাধা দেওয়ার মত কেউ থাকে না, ছোট-খাটো বিষয় নিয়ে কেউ ঝগড়া করেনা, বাবার কাছে কেউ মিথ্যা নালিশ দেয়না, আমার অগোছালো ঘর কেউ গুছিয়ে দেয়না, টাকা থাকার পরও কেউ জোর করে হাত খরচার টাকা পকেটে গুজে দেয়না, মন খারাপ করে থাকলে মন ভালো করার দায়িত্ব কেউ নেয়না, কেউ আর এখন আমার হাসির কারণ হয়না।
.
মোটকথা আমি বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারি রিমি আমার জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমি এই সামান্য জিনিসটা বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলি। তখন আর কিছুই করার ছিলনা। শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া।
আমি রিমির জন্য অপেক্ষা করা শুরু করি। আল্লাহ'র কাছে প্রার্থনা করি সে যেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসে।
.
দেখতে দেখতে ৫ বছর কেটে যায়। রিমি ফিরে আসেনা। তবে আমার বিশ্বাস ছিল রিমি ফিরবে।
ততদিনে আমি পড়ালেখা শেষ করে চাকরিতে জয়েন করি। সারাদিন কর্মব্যস্ততায় গেলেও রাতটা কিছুতেই কাটতো না। রিমিকে বড্ড মিস করতাম। পুরোনো দিনের কথা ভেবে হাসার চেষ্টা করতাম। কিন্তু হাসি আসতো না।
.
রিমি চলে যাওয়ার পর আমি কবে প্রাণখুলে হেসেছিলাম মনে নেই। সে যাওয়ার সাথে সাথে আমার হাসিটাও চলে গেছে। তবুও মানুষের সামনে লোক দেখানো হাসতে হয়। সবাইকে বোঝাতে হয় আমি খুব ভালো আছি, সুখে আছি। বিশেষ করে মা-বাবার সামনে ভালো থাকার অভিনয় করতে হয়। কিন্তু তবুও মা-বাবা ধরে ফেলে। কারণ তারা জানে আমি ভালো নেই। রিমিকে না পাওয়ার যন্ত্রণা আমাকে কুড়ে-কুড়ে খাচ্ছে। আমার কষ্ট দেখে মা-বাবাও লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের জল ফেলে।
.
এভাবেই অভিনয় করতে করতে কেটে যাচ্ছিলো দিনগুলো। আর আজকে রিমি ফিরে এলো। ভেবেছিলাম আজ থেকে অভিনয়ের ইতি টানবো। কারণ আমার ভালোবাসার মানুষ ফিরে এসেছে। যে আমার সব কষ্ট ভুলিয়ে বাঁচতে শিখাবে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম।
রিমি ফিরেছে তো ঠিকই, তবে আমাকে বাঁচাতে নয়, আমাকে মারতে।
.
সত্যি বলতে, সবকিছু এখনো আমার কাছে ঘোরের মত লাগছে। মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি এবং এটা একটা দুঃস্বপ্ন।
বিশ্বাস-ই হচ্ছে না রিমি এভাবে বদলে যাবে। আমাকে ভুলে গিয়ে অন্য একটা ছেলেকে ভালোবাসবে।
আমার এখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। তাহলে কষ্টটা একটু কমতো।
.
-- ভেতরে আসতে পারি.?
.
রিমির কথা ভেবে চোখের অশ্রু ঝরাচ্ছিলাম এমন সময় কে যেন কথাটা বলে উঠলো। আমি দরজার দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম.!
.
চলবে....... ?????


======================================================
ডেঞ্জারাস_মামাতো_বোন🦋🤎
(৪৫তম পার্ট)🌹🌹
Writer:- Mr.Rafi ✍️💝
.
.
-- ভেতরে আসতে পারি.?
.
রিমির কথা ভেবে চোখের অশ্রু ঝরাচ্ছিলাম এমন সময় কে যেন কথাটা বলে উঠলো। আমি দরজার দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম.! রিমি দাঁড়িয়ে আছে।
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই রিমি ঘরে ঢুকলো। আমার পাশে এসে বসলো। আমি রিমিকে এড়ানোর জন্য মিছিমিছি ল্যাপটপে কাজ করছি। রিমি একটু চুপ থেকে শান্ত গলায় বললো,
.
-- কেমন আছো.?
.
-- দেখতেই তো পাচ্ছিস।
.
-- আমি আসাতে তুমি বিরক্তবোধ করছো নাকি.?
.
আমি কিছু বললাম না। আনমনে ল্যাপটপ চাপাচাপি করছি। রিমি আবার বললো,
.
-- আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করলে না তো।
.
-- প্রয়োজন মনে করছি না। তাছাড়া দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ ভালোই আছিস।
.
আমার কথা শুনে রিমি চুপ হয়ে গেলো। হয়তো কষ্ট পেয়েছে আমার কথা শুনে। আড় চোখে রিমির দিকে চেয়ে দেখি চোখের কোণে পানি টলোমলো করছে। এই বুঝি কেঁদে দিবে। কিন্তু রিমি কাঁদলো না। তড়িঘড়ি করে চোখের পানি মুছে বললো,
.
-- তুমি ঠিক আগের মতই আছো। এখনো মানুষের উপরের দিকটা দেখে সবকিছু বিচার করো। কখনো কারো মনের কথাটা বুঝার চেষ্টা করো না।
.
-- আমার অত বুঝে কাজ নেই। আর আমি যেমন ছিলাম তেমনি আছি। তোর মত বদলে যাই নি।
.
রিমি আমার কথার অর্থ মনে হয় বুঝতে পারে নি। কেমন ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আমি কড়া গলায় বললাম,
.
-- আমার ঘরে কেন এসেছিস.? তোর স্বামী মনে হয় তোকে খুঁজছে।
.
-- স্বামী.! কার স্বামী.? এসব কি বলছো তুমি.?
.
অবাক হয়ে প্রশ্ন করে রিমি। আমার প্রচন্ড রাগ উঠে। ঢং দেখলে বাঁচি না। বিদেশ থেকে বিয়ে করে এসেছে, এখন আবার স্বামীকে চিনে না। আমি রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বললাম,
.
-- অত নাটক দেখাতে হবে না। নিচে যে ছেলেটা বসে আছে সেই ছেলেটা তোর স্বামী হয়। কি ভেবেছিস আমি কিছু বুঝিনা.?
.
আমার কথা শুনে রিমি কিছুক্ষণ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু কিছু বলে না। বসা থেকে উঠে চলে যেতে থাকে। আমি বিদ্রুপের স্বরে বলি,
.
-- ছেলেটার সাথে তোকে কিন্তু দারুণ মানিয়েছে.! তা কবে বিয়ে করেছিস.? আমাকে একবার জানাতে পারতি।
.
রিমি এবার মুখ খুললো। ঘরে আসার পর থেকে সে নরম স্বরেই কথা বলছিলো। কিন্তু এবার রিমির চেহেরায় কিঞ্চিৎ রাগের আভা ফুটে উঠেছে। রিমি বেশ কড়া গলায় বললো,
.
-- তুমি আমার কে যে তোমাকে জানাতে যাবো। তুমি আগেও আমার কেউ ছিলে না, এখনো কেউ নও। আর বিদেশে যাওয়ার কিছুদিন পরেই আমি শরীফকে বিয়ে করেছি। কিছুদিন পর আমাদের বাচ্চাও হবে।
.
রিমির কথাগুলো শুনে আমার বুকটা ফালাফালা হয়ে গেলো। আমার ধারণাই তাহলে ঠিক। শরীফ নামের ছেলেটা রিমির স্বামী। সত্যি বলতে কষ্টে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে।
রিমি কি করে এমনটা করতে পারলো। আমাকে ভালোবাসা শিখিয়ে নিজেই কিনা অন্যকাউকে ভালোবাসলো.! একটি বার ভাবেনি তাকে ছাড়া আমি কিভাবে বাঁচবো। মানছি রিমিকে আগে না বুঝে অনেক কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু তাই বলে আমাকে এত বড় শাস্তি দিবে.? এর চেয়ে ভালো রিমি আমাকে মেরে ফেলতো। নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্যের হতে দেখা সত্যি-ই বড় বেদনাদায়ক। আমি চোখের কোণে জমে থাকা পানি মুছে বললাম,
.
-- শুনে ভালো লাগলো। দোয়া করি তোরা সুখী হ।
.
-- ধন্যবাদ.! আর হ্যাঁ, আম্মু তোমাকে খেতে লাগছে।
.
-- ক্ষিদে নেই।
.
-- কেন.? বেলা তো অনেক হয়েছে। এখনো ক্ষিদে লাগেনি কেন.?
.
-- এমনি। বিরক্ত না করে যা তো এখান থেকে।
.
-- বুঝেছি। আসলে আমি বিয়ে করেছি শুনে তুমি মোটেও খুশী হওনি। খুব কষ্ট পেয়েছো তাইনা.?
.
রিমির কথা শুনে রাগটা আরো বেড়ে গেলো। এখন আমার কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছে। আমি রাগে আগুন হয়ে বললাম,
.
-- এতই যখন বুঝিস তাহলে বিয়েটা করলি কেন.? আবার নাকি বাচ্চাও হবে.!
.
-- কি করবো বলো, বিদেশে গিয়ে আমি শরীফকে ভালোবেসে ফেলি। তাই বিয়ে করেছি।
.
-- কিন্তু তুই তো আমাকে ভালোবাসতি। বিদেশে যাওয়ার আগে চিঠিতে কি লিখেছিলি মনে নেই.?
.
-- উহু, মনে নেই। তাছাড়া ওসব কথা আর মনে রাখতে চাইনা। মানছি একসময় তোমাকে ভালোবেসেছিলাম, তোমার জন্য পাগল ছিলাম। কিন্তু এখন আর তোমাকে ভালোবাসি না। এমনকি বিদেশে যাওয়ার পর তোমার কথা মনেও পড়তো না। বরং অতীতের কথা ভেবে হাসতাম। কি বোকাটাই না ছিলাম আমি। তোমার জন্য কত্ত পাগলামি করেছি। হাহাহা.!
.
রিমি শব্দ করে হাসতে লাগলো। আমি নিজেকে আর আটকাতে পারলাম না। অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। মানুষ ঠিকই বলে, দূরে গেলে ভালোবাসা কমে।
রিমি যখন এখানে ছিলো তখন আমাকে পাগলের মত ভালোবাসতো। কিন্তু বিদেশে যাওয়ার পর সব পাল্টে গেছে। সে আমাকে ভুলে অন্যের সাথে জীবন বেঁধেছে। ইশ, কয়েকটা বছর আগে যদি রিমির ভালোবাসাটা বুঝতাম তাহলে জীবনটা অন্যরকম হতো। আজ শরীফের জায়গায় আমি থাকতাম। জীবনে ভালোবাসার কমতি থাকতো না।
আমি এসব ভাবছি আর অশ্রু ঝরাচ্ছি। রিমি আমার চোখের পানি দেখে অবাক হওয়ার ভান করে বললো,
.
-- এমা.! তুমি কাঁদছো কেন.? কি হয়েছে তোমার.?
.
আমি তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে বললাম,
.
-- কিছু না। চোখে পোকা পড়েছিলো।
.
আমার কথা শুনে রিমি মুচকি হাসলো। আমি যে মিথ্যা বলেছি তা সে বুঝে ফেলেছে। রিমি একটু চুপ থেকে বললো,
.
-- তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেসা করবো.?
.
-- না। তুই এখান থেকে যা তো। তোর স্বামী মনে হয় তোকে খুঁজছে। অনেক্ষণ ধরে এখানে আছিস।
.
-- ধুর, কিচ্ছু হবে না। আগে আমার একটা প্রশ্নের দাও তারপর যাবো।
.
-- তাড়াতাড়ি বল।
.
-- আমি জানি শরীফকে বিয়ে করাতে তুমি একটুও খুশী হওনি। কিন্তু কেন বলো তো.? তুমি কি আমাকে ভালোবাসো.?
.
-- না।
.
ছোট করে উত্তর দিলাম আমি। রিমির সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। তবে রিমির কথার জবাবে বলতে ইচ্ছে করছিলো আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। কিন্তু বলি নি। ভেতর থেকে বাঁধা এলো। রিমি এখন বিবাহিতা.! আমি যে ওকে ভালোবাসি তা বলা ঠিক হবে না। তাছাড়া আমি যে রিমির প্রতি দুর্বল তা প্রকাশ করা উচিত না। রিমি আরো পেয়ে বসবে তখন।
আর সবচেয়ে বড় কথা আমার ভালোবাসা রিমির কাছে কোনো মূল্য নেই। তাই রিমিকে এক সাগর পরিমাণ ভালোবাসার পরও প্রকাশ করলাম না। কিন্তু রিমি আমার কথা শুনে হাসা শুরু করে দিলো। আমার গা জ্বলে গেলো রিমির হাসি দেখে। রিমি কোনোমতে হাসি থামিয়ে বললো,
.
-- মিথ্যাে বলো না। আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো।
.
-- বললাম তো ভালোবাসি না।
.
-- তাহলে এখনো বিয়ে করোনি কেন.? কার অপেক্ষায় বসে আছো.? আমার.? কিন্তু আমি তো বিয়ে করে ফেলেছি। এখন তোমার কি হবে.? ইশ, আমি তোমাকে ছ্যাকা দিলাম তাইনা.? হাহাহা.!
.
রিমি আরো জোরে জোরে হাসতে লাগলো। সব জেনেও রিমি আমাকে নিয়ে মজা করছে। আমি আর নিজেকে আটকাতে পারলাম না। প্রচন্ড রাগ উঠলো। রিমিকে ধমক দিলাম। রিমি হাসি থামিয়ে চোখ সরু করে তাকিয়ে রইলো। আমি কিছু বলতে যাবো এমন সময় মা ঘরে ঢুকলো। তারপর রিমি ও আমার উদ্দেশ্যে বাজখাই গলায় বললো,
.
-- সারাদিন কি শুধু গল্প করেই কাটাবি.? কখন থেকে খাবার নিয়ে বসে আছি।
.
-- আমার ক্ষিদে নেই। তোমার আদরের ভাগ্নিকে বেশি করে খাওয়াও।
.
-- মেয়েদের মত ঢং করিস না তো। খাবি চল।
.
মা আমাকে জোর করে খাবার টেবিলের কাছে নিয়ে গেলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে আমি আরেক দফা অবাক হলাম। শরীফ নামের ছেলেটার পাশে অন্য একটা মেয়ে বসে আছে। নতুন বউয়ের মত মাথায় ইয়া বড় ঘোমটা দেওয়া এবং মাথা নিচু করে খাবার খাচ্ছে। আমার এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে শরীফ মুচকি হাসলো। কিন্তু কিছু বললো না। আমি মাকে ইশারায় বললাম মেয়েটা কে। মা হাসিমুখে জানালো মেয়েটা শরীফের বউ।
.
আমি এবার এতটাই অবাক হলাম যে এই বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে যাবো। শরীফের সাথে তো রিমির বিয়ে হয়েছে। তাহলে এই মেয়েটা শরীফের বউ হয় কি করে.? মাথায় তো কিচ্ছু ঢুকছে না। সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
.
চলবে....... ??????