শরীফ যখন রিমি বাদে অন্য একটা মেয়েকে নিজের বউ বলে পরিচয় দিলো তখন আমি এতটাই অবাক হলাম যে এই বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে যাবো। শরীফের সাথে তো রিমির বিয়ে হয়েছে। তাহলে এই মেয়েটা শরীফের বউ হয় কি করে.? মাথায় তো কিচ্ছু ঢুকছে না। সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
.
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে চেয়ার টেনে বসলাম। একটুপর রিমিও খেতে এলো। আমার পাশে গা ঘেঁষে বসলো। আমি আড় চোখে রিমির দিকে একবার তাকালাম। আমার এমন নাজেহাল অবস্থা দেখে সে মুখ টিপে হাসছে। এমন একটা ভাব রিমি আমাকে খুব বাজেভাবে বোকা বানিয়েছে। আমার মনে সন্দেহ জাগলো। আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে শরীফকে বলেই দিলাম,
.
-- আপনি কবে বিয়ে করেছেন ভাই.?
.
-- বিয়ে করার তো অনেকদিন হলো। ৭ বছরের একটা ছেলেও আছে।
.
-- ও। আচ্ছা পাশে বসা মেয়েটাই কি আপনার বউ.?
.
-- জ্বী।
.
-- খুব ভালো। কিন্তু একটু আগে যখন আপনার সাথে দেখা হয় তখন তো আপনার বউকে দেখলাম না।
.
-- তখন সে একটু ওয়াশরুমে গিয়েছিলো। কেন বলো তো.? কোনো সমস্যা.?
.
-- না, এমনি জিজ্ঞেস করলাম।
.
শরীফ আর কিছু বললো না। কিন্তু তখনো আমার সন্দেহ কাটেনি। সবকিছু মিথ্যা মনে হচ্ছে। তাই শরীফকে বোকার মত একটা প্রশ্ন করে বসলাম। বললাম,
.
-- ভাই, সত্যি-ই কি মেয়েটা আপনার বউ হয়.? নাকি আমার সাথে মজা করছেন.?
.
আমার কথা শুনে পাশে বসা রিমি ফিক করে হেসে দিলো। আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। নিজেকে আহাম্মক মনে হচ্ছে। শরীফ হেসে উত্তর দিলো,
.
-- আগে জানলে বিয়ের কাবিননামা সাথে করে নিয়ে আসতাম। তাহলে হয়তো তোমার বিশ্বাস হতো। মানছি আমার বয়সটা একটু বেশি। কিন্তু এতটাও বেশি না যে আমার বউয়ের পাশে আমাকে মানায় না এবং আমাদের স্বামী-স্ত্রী বলে মনে হয় না। লন্ডনে সবাই আমাদের 'মেড ফর ইচ আদার' বলে ডাকে।
.
-- আরে ভাই আমি ওভাবে বলতে চাইনি। জাস্ট মজা করে বলেছি। আপনাদের জুটি মাশআল্লাহ্ দারুণ.!
.
-- তোমার আর রিমির জুটিও তো দারুণ ছিলো। তাহলে এতগুলো দিন আলাদা ছিলে কেন.?
.
শরীফের কথা শুনে চমকে গেলেও নিজেকে সামলে নিলাম। তার মানে তিনি আমার ও রিমির ব্যাপারে জানেন। রিমি হয়তো তাকে সব বলেছে।
আমি আড় চোখে রিমির দিকে একবার তাকালাম। ওর হাসি ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। মুখ ভার করে খাবার খাচ্ছে। আমি শরীফকে কিছু বলার আগেই বাঁধ সাধলো মা। ধমক দিয়ে বললো,
.
-- খেতে বসে এত কথা কিসের.? চুপচাপ খাও।
.
আমি আর কিছু বললাম না। তবে মনে মনে খুব খুশি হলাম। এই ভেবে যে রিমি এখনো বিয়ে করেনি। কারণটা আমি জানি। আজও রিমির মনে কেবল আমি-ই আছি। রিমি যতই মুখে না বলুক বা অভিনয় করুক।
সত্যি বলতে রিমিকে আজও আমি বুঝতে পারলাম না। বরাবরের মত কেবল ওর মুখের কথাই বিশ্বাস করে গেলাম। একটু আগে যখন রিমি বলেছিল সে শরীফকে বিয়ে করেছে এবং কিছুদিন পর ওর বাচ্চা হবে- তখন রিমির ব্যাপারে আমি কত খারাপ চিন্তা করেছিলাম। অথচ রিমি সেসব মজা করে বলেছিল। রিমি ঠিকই বলে, আমি সারাজীবন শুধু ওর মুখের কথাটাই বিশ্বাস করে গেলাম। ওর মনের কথা কোনো দিন বুঝার চেষ্টা করলাম না।
.
যাইহোক, খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘরে এসে রিমির কথা চিন্তা করছিলাম। এতগুলো বছর প্রতিক্ষার পর রিমির সাথে দেখা, তবুও কাছাকাছি যেতে পারছি না। একটা অদৃশ্য বাঁধা কাজ করছে।
আমি আনমনে এসব ভাবছিলাম হটাৎ দেখি রিমি ঘরে ঢুকলো। তার হাতে ঝাটা.! একটু অবাক হলাম আমি। রিমি ঝাটা দিয়ে কি করবে.? আমি কিছু বলার আগেই রিমি বাজখাই গলায় বলতে লাগলো,
.
-- ঘরটাকে এমন বস্তি বানিয়ে রেখেছো কেন.? ছি.! এমন ঘরে মানুষ থাকে.? আমার তো দেখেই বমি আসছে। দেখি সরো তো, আগে বিছানাটা গুছিয়ে দেই।
.
আমি বিছানা থেকে উঠে দূরে সরে দাঁড়ালাম। রিমি পাক্কা গৃহিনীর মতো বিছানা গুছাতে লাগলো। সত্যি বলতে এখন রিমিকে একদম বউ বউ লাগছে। শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুজে কি সুন্দরভাবেই না কাজ করছে। আমি রিমির পিছনে দাঁড়িয়ে চুপচাপ ওর কাজ করা দেখছি।
হটাৎ রিমির কোমড়ের দিকে নজর গেলো। রিমি উপুড় হয়ে কাজ করাতে এবং শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুজে থাকাতে ওর ভর্সা পেট ও কোমড়ের অনেকখানি অংশ বেরিয়ে এসেছে। আমি দৃষ্টি সরাতে পারলাম না। অপলক দৃষ্টিতে রিমির লোভনীয় পেট ও সরু কোমড়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি যে পিছন থেকে লোভাতুর দৃষ্টিতে রিমির পেট ও কোমড় দেখে যাচ্ছি রিমি মনে হয় তা বুঝতে পেরেছে। তাই ঘাড় ঘুরিয়ে বাঁকা চোখে আমার দিকে একবার তাকালো। সাথে সাথে আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। তবে রিমি কিছু বললো না। উল্টো আমাকে অবাক করে দিয়ে শাড়ির আঁচলটা আরেকটু সরিয়ে দিলো যাতে রিমির পেট ও কোমড় দেখতে সুবিধা হয়। ব্যস, আমাকে আর পায় কে.! দিন-দুনিয়া ভুলে আমার পুরো মনোযোগ রিমির পেট ও কোমড়ের দিকে করলাম। ইশ, যদি একবার ছুঁতে পারতাম.!
.
এভাবে কিছুক্ষণ কেটে গেলো। রিমি বিছানা গুছানো শেষ করে আমার দিকে ফিরে তাকালো। তারপর মুচকি হেসে বললো,
.
-- দেখা হয়েছে জনাবের.? এবার এখান থেকে যাও। শরীফ ভাই তোমাকে ডাকছে।
.
-- কেন.?
.
-- জানিনা। উনি ছাদে আছেন। তোমাকে যেতে বলেছে।
.
আমি আর কিছু না বলে ঘর থেকে রেরিয়ে ছাদে যেতে লাগলাম। শরীফ আবার আমাকে কেন খুঁজছে.? আমি মনে একরাশ কৌতুহল নিয়ে ছাদে গেলাম। শরীফ ছাদের রেলিং-এ হেলান দিয়ে সিগারেট টানছে। আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। শরীফ আমাকে আধ খাওয়া সিগারেট বাড়িয়ে দিলো। রিমি যাওয়ার পর থেকে সিগারেট ছুঁয়েও দেখিনি। কিন্তু কেন জানি আজ না করতে পারলাম না। শরীফের থেকে সিগারেট নিয়ে টানতে লাগলাম। শরীফ শান্ত গলায় বললো,
.
-- তুমি আমাকে রিমির স্বামী ভেবেছিলে তাইনা.?
.
শরীফের কথা শুনে লজ্জায় পড়ে গেলাম। নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে বললাম,
.
-- আসলে পরিস্থিতি এমন তৈরি হয়েছিলো যে না ভেবে উপায় ছিলো না। মাথায় শয়তান ভর করেছিলো। তাছাড়া রিমিও আপনাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলেছিলো।
.
-- হুম, শুনেছি। রিমি একটু আগে আমাকে বললো। কিন্তু বিশ্বাস করো রিমির সাথে আমার কোনো খারাপ সম্পর্ক নেই। রিমিকে আমি নিজের বোন মানি। তার উপর রিমি আমার বউয়ের বান্ধবী। লন্ডনে আমার পরিবার এবং রিমি একই বিল্ডিং-এ থাকতাম।
রিমির মুখে তোমার কথা অনেক শুনেছি। সবসময় শুধু তোমার কথাই বলতো। খুব ভালোবাসে তোমাকে.! কিন্তু দুঃখের বিষয় তুমি ওর ভালোবাসা বুঝোনি। যে কারণে মেয়েটা এতগুলো বছর কষ্ট পেয়েছে।
.
-- কষ্ট তো আমিও পেয়েছি। রিমি আমাকেও কম কষ্ট দেয়নি।
.
-- রিমি আবার তোমাকে কবে কষ্ট দিলো.? তুমি নিজের দোষে এতদিন কষ্ট পেয়েছো। রিমি যখন লন্ডনে চলে যায় তুমি চাইলেই তো ওকে ফিরিয়ে আনতে পারতে। তুমি তো ওর ঠিকানা জানতে। কিন্তু তা না করে রিমির উপর রাগ করে বসে ছিলে। জানো তোমাকে ছাড়া রিমির দিন কিভাবে কেটেছে.? মেয়েটা তোমার ছবি বুকে জড়িয়ে কাঁদতো, তোমার প্রতিক্ষায় পথ চেয়ে বসে থাকতো। কিন্তু তুমি আসো নি। দীর্ঘ পাঁচটা বছর ওকে অপেক্ষা করিয়েছো। এই পাঁচ বছরে রিমিকে কখনো ভালোভাবে হাসতে দেখিনি। কিন্তু যখন রিমি ফ্লাইট থেকে নেমে দেশের মাটিতে পা রাখলো, ওর খুশি যেন আর ধরে না। তোমাকে দেখার কন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলো সে। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি- এইটুকু রাস্তা রিমি যে কিভাবে এসেছে তা শুধু আমি জানি। কিন্তু এতগুলো বছর পর রিমিকে দেখেও আবার তাকে ভুল বুঝলে। আমাকে রিমির স্বামী ভেবে বসলে। আচ্ছা একটি বারের জন্যও কি তোমার মাথায় আসেনি যে মেয়ে তোমাকে পাওয়ার জন্য এত কিছু করেছে সে কিভাবে আমাকে বিয়ে করবে.?
.
শরীফের কথার জবাবে কিছু বলার ভাষা পেলাম না। সে সত্যি কথাই বলেছে। আমি বারবার শুধু রিমিকে ভুল বুঝি। আমার চুপ থাকা দেখে শরীফ আমার কাধে হাত রেখে শান্ত গলায় বললো,
.
-- রিমির মত মেয়ে পেতে ভাগ্য লাগে। তুমি হয়তো জীবনে হাজারটা মেয়ে পাবে যে তোমাকে ভালোবাসবে। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি রিমির মত কাউকে পাবেনা। তাই আর অভিমান করে থেকো না। আমি লন্ডন থেকে এসেছি শুধু তোমাদের মিল করে দেওয়ার জন্য। কারণ রিমির কষ্ট আমার আর সহ্য হচ্ছিলো না।
.
-- রিমির সাথে আমি অনেক অন্যায় করেছি। ওর সামনে দাঁড়াবো কিভাবে.?
.
-- বোকা কোথাকার.! রিমি তোমাকে অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছে। তা না হলে তোমার টানে ফিরে আসতো না। আসলে রিমি শুধু দূরে গিয়ে বুঝাতে চেয়েছিলো তুমি তাকে ছাড়া অপূর্ণ এবং রিমি সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে। তোমরা হলে একে-অপরের পরিপূরক.! কেউ কাউকে ছাড়া চলতে পারো না। শোনো, তুমি শুধু রিমির সামনে গিয়ে ভালোবাসি বলবে। দেখবে সাথে সাথে রিমির সব মান-অভিমান হাওয়া হয়ে গেছে।
.
আমি মাথা নাড়িয়ে সেখান থেকে চলে এলাম। অনেক হয়েছে মান-অভিমানের খেলা। এবার সেসব মিটানোর পালা। সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করবো।
আমি ছাদ থেকে নেমে ঘরে ঢুকলাম। রিমি তখনো আমার ঘর গুছাতে ব্যস্ত। এই মূহুর্তে রিমিকে একদম বউয়ের মতো লাগছে। আগে রিমির মাঝে যে বাচ্চামি ভাবটা ছিলো তা এখন অনেকটাই হারিয়ে গেছে। কারণ রিমি এখন নারীতে পরিণত হয়েছে। আমি পিছন থেকে রিমিকে ডাক দিলাম। ঘর গুছাতে ব্যস্ত থাকায় আমাকে খেয়াল করেনি এখনো। আমার ডাক শুনে ফিরে তাকালো। স্ফিত হেসে বললো,
.
-- শরীফ ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিলো.? কি বললো সে.? আচ্ছা তুমি বসো, আমি তোমার জন্য চা করে আনি।
.
রিমি চা আনতে যাবে তার আগেই ওর হাত ধরে ফেললাম। তারপর হেচকা টান দিয়ে ওকে আমার সামনে দাঁড় করালাম। রিমি ভ্রু-কুঁচকে তাকালো। তার চোখে-মুখে বিষ্ময়.! আমি স্থির দৃষ্টিতে রিমির দিকে তাকিয়ে আছি। কাজ করার ফলে রিমির সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। সারা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম যেন রিমির সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মুক্তার মত রিমির ঘামের কণাগুলো চিকচিক করছে।
আমি মুগ্ধ হয়ে রিমির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর নিজেকে আর আটকাতে পারলাম না। ঝড়ের বেগে রিমিকে জড়িয়ে ধরলাম। রিমি চমকে উঠলো। আমি এমন কিছু করবো সে কল্পনাও করেনি হয়তো। কেমন পাথরের মত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি রিমিকে শক্ত করে নিজের বুকের মাঝে চেপে রেখেছি। সেই সাথে রিমির ঘাড়ে, গলায়, কানের লতিতে এবং মাথায় চুমুর বর্ষণ করে চলেছি। রিমি বাঁধা দিচ্ছে না। একটুপর তাকে ছেড়ে দিলাম। রিমির বিষ্ময় এখনো কাটেনি। চেহেরা জুড়ে এমন একটা ভাব যেন সে স্বপ্ন দেখছে। আমি রিমির হাতজোড়া আমার হাতের মাঝে নিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে বললাম,
.
-- আমাকে ক্ষমা করে দে রিমি। আমি তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি।
.
আমার কথা শুনে রিমি কিছুক্ষণ শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। ভাবলাম এবার মনে হয় সব মান-অভিমানের খেলা শেষ হবে। রিমি আমাকে আপন করে নিবে। কিন্তু রিমি আমার ধারণা এবং সব আশা-আঙ্কাখাকে ভেঙে দিয়ে ঠাস করে আমার গালে চড় বসিয়ে দিলো। আমি অবাক হলাম খুব.! তাহলে কি রিমি আমাকে ভালোবাসেনা.?
.
চলবে........ ????????