আমি প্রচন্ড শীতকাতুরে একটা মেয়ে। শীতে দিনের বেলাটা কোন ভাবে পাড় করে ফেলতে পারি।কিন্তু সন্ধ্যে হতে হতে আমি কানটুপি,হাত মোজা,পা মোজা সোয়েটার পরে সঙ সেজে বসে থাকি। মাঝে মাঝে তো সোয়েটারে শীত মানে না। তার জন্য কম্বল গায়ের সাথে পেঁচিয়ে রাখি৷ মানুষ মাদকাসক্ত হয় আর আমি শীতাসক্ত। এই ঘর থেকে ওই ঘরে যেতে হলে ভূতের মতো দুলে দুলে যাওয়া লাগে৷আমায় দেখলে লোকে ভাববে শীত বস্ত্রের একটা স্তুপ হাটছে। একদিন তো আম্মু অন্ধকারে আমায় হেলেদুলে হাটতে দেখে ভয়ে চিৎকার মেরে আয়াতুল কুরসি পড়তে থাকে৷ তিনি ভেবেছেন ঘরে ভূত জ্বিন কিছু হাটছে৷ ওই মুহূর্তে আম্মুর চিৎকারে আমি দিগুণ চিৎকার মেরে পুরো বাড়ি যেন কাঁপিয়ে তুলি।
শীতের দিনে অনেক ছল-চাতুরীর অনুগ্রহে যেতে হয় আমার। রাতের খাবারটা যাতে আম্মু খাইয়ে দেই। হাত মোজা খুলে ভাত না খাওয়ার জন্য। নানা রকম ইমোশনাল অত্যাচার করা,শুরু করি। কতো ধরনের যে ভং ধরি তা তো বলার বাইরে৷ কিন্তু এখন সব অতীত আমার কাছে। যবে থেকে হিমু নামক বান্দাটা জোর কথা আমার কপালের সাথে তার কপাল ঘষেছে সেদিন থেকে আমার কপালে শনির দশা লেগে গিয়েছে। ভুল করে মঙ্গল কি তা স্মরণ করতে পারিনা। তার সুখের দিন শুরু আর আমার দুঃখের দিন। একটা কথা আছে অতি বাড় বেরোনা ঝড়ে পরে যাবে৷সেইম ফিলিংস আমার৷ আগে বাপের বাড়ি যা যা আমি আমার মায়ের সাথে করতাম তা হিমু এখন আমার উপর করছে৷ 
 
 

 
তার সারাদিন শীতের কোন হদীস থাকেনা কিন্তু খাবার খাওয়ার বেলায় নাকি তার হাত বরফে জমে যায়। তখন সমগ্র শীত নাকি তার উপর ভর করে। ঠান্ডা লাগার ভয়ে পানি ছুঁতে চাইনা আর সে জোর করে করে এটা করো ওটা করো করো জান তামাম করে ফেলে। দিনে তবু শান্তি মিলে৷কারণ দিনে সে অফিসে থাকে৷আর দিনে আমার সমস্যা হয়না। যতো সমস্যা সন্ধ্যা থেকে৷ গরীবের সুখ নাকি কারো সহ্য হয়না। আর আমার সুখ হিমুর সহ্য হয়না।আমায় শীতে কাঁপতে দেখলে তার বেজায় মজা লাগে। আর সে তা উপভোগ করে বেশ করে। পানিতে হাত ভিজিয়ে সে হাত এসে আমার গালে লাগিয়ে দেই।আর আমি ওমাগো বলে আৎকে উঠি৷নানার বাহানা করে রাতে খাবোনা বললে তখন সে বলে, তুমি না খেলে না খাও আমার খিদে লেগেছে তুমি খাইয়ে দাও। বুঝলা আজ খুউউব শীত পকেটের ভিতর থেকে হাতগুলো বের করতে ইচ্ছে করছেনা। তুমি একটু খাইয়ে দাওতো। আর আমার অবস্থা তখন, যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়, সে প্রবাদের মতো। সত অনিচ্ছা শর্তেও হাত মোজা খুলে কনকনে ঠান্ডা পানি দিয়ে হাত ধুয়ে মহাশয়ের জন্য আমার ভাত মাখা লাগে। আর সে খেতে খেতে ফরমায়েশ খাটে৷ এটা দাও বেশি করে। ওই তরকারি কম করে দাও।পানি খাইয়ে দাও ব্লা ব্লা। আর আমার অবস্থা তখন কি রকম অশোচনীয় হয় বলার বাইরে৷ তার খাওয়া শেষ হলে সে পকেট থেকে হাতদুটো বের করে মাথার পিছনে নিয়ে শরীরের আলস্য ছেড়ে আয়েশ ভঙ্গিতে বলে, আহ বউয়ের হাতের মাখা ভাতে এতো সুস্বাদু ইচ্ছে করে সারাদিন খেতে থাকি আর খেতে থাকি। আর মুখে থাকে এক তৃপ্তি হাসি যেটাতে থাকে আমাকে নাজেহাল করার মজা। তাকে কিছু বলতে না পেরে আমি আমার সমস্ত রাগ আমি চেয়ার টেবিল ঘরের নানা রকম জিনিষের উপর বের করি। ধুমধাম পায়ে ওর এটো প্লেট নিয়ে কিচেনে চলে যেতে নিলে সে আমায় বসিয়ে দিয়ে বলে,
" আরেহ বসো৷
তার কথায় গাল ফুলিয়ে বসে থাকলে তখন সে নিজে প্লেটে খাবার বেড়ে নিতে নিতে বলে,
" আমি কারো ধার রাখিনা। সে বউ হোক বা অন্য কেউ। তুমি আমায় খাইয়ে দিয়েছো এখন আমার পালা।
আমি রাগ করে খাবোনা বললে তখন সে আমার গাল চেপে ধরে হা করিয়ে মুখে ভাত পুরে দেই। তারপর বলে, আমি অন্যদের মতোনা, জান, বাবু ডেকে ডেকে বাবু খাওনা বলবো। লাথির ভূতের নাকি কথাতে হয়না। তুমি হলে সে ভূতটা। ঘ্যাওড়া। সো চুপচাপ খেয়ে নাও। নাহলে ঠান্ডা পানিতে চুবানি দিবো।
ওর কথা শুনে অতি দুঃখে,আবেগে কাঁন্না চলে আসে। এ কেমন বর কপালে এসে জুটেছে। একটু দয়ামায়া কেন দেখায়না? ভিতরে ভিতরে কাঁদতে কাঁদতে আস্ত একটা পুকুর বানিয়ে ফেলেছি বোধহয় আমি হিমায়াতের অত্যাচারে। ওরফে হিমু মহাশয়।
হিমু আমার উল্টোপিঠ৷ তার গরম সহ্য হয়না। শীত কাল যেন তার জন্য দুধভাত। শীতে কখনো তাকে ভালো করে গরম কাপড়ে পরতে দেখিনি৷ মাঝে মাঝে তো এমন সেন্টু গেঞ্জি আর হাফ প্যান্ট পরে ঘুরছে সে সারা ঘরে। তার অবস্থা দেখে আমার শীত মাত্রাদিক শুধু বাড়তে থাকে। আর গরম কালে তার নাজেহাল অবস্থা৷ মাঝে মাঝে তো কনকনে ঠান্ডার মাঝেও ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে বসে থাকে। তার ফ্যান চালানো দেখে আমার শীত দিগুণ থেকে বেড়ে তিনগুনে চলে আসে। আমি বসে বসে কাঁপতে থাকি।দাঁতের সাথে দাঁত বারি খেয়ে টকটক শব্দ করে। কনকনে শীতের রাতে মাঝে মাঝে মাঝে নাফি নামক বদজাতটাও এসে হাজির হয়। আর সেদিন বিশাল ভোজনের আয়োজন করা লাগে আমার। কয়েক পদের রাঁন্না সব আমার একা করা লাগে। রাঁন্না হিমুর হাত ধরে শেখা৷ আগে আমায় রাঁন্নায় হেল্প করতো এখন সেটা একদম ই করেনা। নাফি কে দেখলে ইচ্ছে করে খুন্তি গরম করে তার পাছায় লাগিয়ে দিই। আমি বাংলার নবাবের সাথে বেইমানি করা মীর জাফরকে দেখিনি কিন্তু নাফিরে দেখছি। আমার সাথে দুই নাম্বারি করে হিমুর দলে যোগ দিয়েছে৷ কতো ইচ্ছে এই নাফি আর হিমু দুইটার সাইজ করবো কিন্তু তাদের সাইজ করতে গিয়ে উল্টো হিমুর হাতে নিজের সাইজ হওয়া লাগে। আমিও হাল ছাড়িনা, সময় এবং স্রোত কখনো একসাথে প্রবাহিত হয়না। আমার দিন আসবে একদিন আর দুইটারে এমন সাইজ করবো আমার সাথে বাটপারি করার পরিনতি বুঝবে৷
নাফি আর হিমু দুইজন ছাদে গিয়ে ইচ্ছে মতো ব্যাটমিন্টন খেলে আসলে আয়েশ করে খেতে থাকে। আর আমার তা পরিবেশন করা করা লাগে শীতে কাঁপতে কাঁপতে। নাফিতো ন্যাঁকামো করে করে বলে,.
" বাহ তাশা তোর তো বেশ উন্নত হয়েছে। শীতের কাবু থেকে বের হয়ে শীতকে কাবু করতে শিখেছিস। যাই বল তুই কিন্তু ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞ। সব তার কৃতিত্ব। সে না হলে তুই সে সেই থেকে যেতি। জীবনে উন্নতি আর হতোনা৷
আমি নাফির কথায় বত্রিশটা দাঁত বের করে হেসে মনে মনে বলি, তোরে শালা সুযোগে পাই লই। তারপর দেখামুনে ভাইয়ের গুনগান করার কুফল৷ নাফির কথায় হিমু খেতে খেতে বলে,
" সোজা আঙ্গুলে কাজ না হলে আঙ্গুল বাঁকাতে হয়। দরকার হলে বাঁশ বা লাঠির প্রয়োগ করা লাগে। তবে না কাজ হবে৷
" এটা কিন্তু ঠিক বলেছেন।
কথাগুলো আমায় লক্ষ্য করে করে বলছে বুঝতে পেরে হাত থেকে চামচ ধাম করে বাটিতে ছুড়ে মেরে আমি রুমে এসে তাদের দুইজনের মুখের উপর ধাম করে দরজা বন্ধ করে দেই তাদের হতবুদ্ধি মার্কা মুখটার উপর৷ কম্বল একদম পুরোদমে গায়ের সাথে পেঁচিয়ে শুয়ে পরি।
মাথায় হাতের আলতো পরশে আমার ঘুম আলগা হয়ে যায়৷হিমায়াত চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। কপালে তার উষ্ণ ঠোঁট আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে আদুরে গলায় বলে,
" রাগ কমলে একটু ওঠো।
তার কথার পাত্তা না দিয়ে আমি একপাশ হয়ে কম্বল শক্ত করে চেপে ধরে ঘুমের ভান ধরে থাকি৷ এটা তার রাগ ভাঙ্গানোর একটা ফন্দি। সকাল হলো সে আর এই হিমু থাকবেনা তা আমার জানা। আমায় আওয়াজ না পেয়ে হিমু আমায় তার কোলে তুলে নেই। কম্বল পেঁচানো অবস্থায়। ড্রয়িংরুমে আসতে ঠাস করে আলো ঝলে ওঠে। আলো চোখে লাগতে আমি মুখ হিমুর বুকের ভিতর গুজে নিই। তখন আমার কানে হিমু ফিসফিস করে বলে ,
" Happy Anniversary Many Many happy returns of the day. Misses TashaRani.
হিমুর কথায় আমি চোখখুলে ওর দিকে তাকায়। একরাশ হাসি তার মুখে ঢেউ খেলছে। আমি মুগ্ধ নয়নে তার দিকে চেয়ে থাকি। তার এই মুগ্ধ হাসি আমি দেখিনি। নাকি সে দেখায়নি জানিনা। বিয়ের পর তার ভালোবাসা কম শাসন দেখেছি। আর সে নাকি বিয়ে বার্ষিকী মনে রেখেছে। আর আমার কিন্তু মনে দিলেও ছিলোনা এই দিনের কথা। ইনফ্যাক্ট আমি তো মাঝে মাঝে এটাও ভুলে যায় আমার বিয়ে হয়েছে আমার একটা সংসার হয়েছে৷ হিমু আস্তে করে তার কোল থেকে নামিয়ে আমার শরীর থেকে কম্বলটা নিয়ে নেই। আমি নিজে নিজেকে দেখে থ! আমার গায়ে একটা সিল্ক সাদা শাড়ি পরা। কিছুটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। হিমায়াত যত্ন করে শাড়ি ঠিক করে দেই। হাত দিয়ে চুল ঠিক করে দিয়ে ড্রয়িংরুমের বেসিনের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলে দেখোতো আমার পাখিটাকে কেমন লাগছে? আমি আয়নার দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। ও আমায় ওর মনের মতো করে সাজিয়েছে। যেমন সে বিয়ের আগে আমায় বলতো। সাদা পরি। হিমায়াতের যত্ন করে লুকিয়ে রাখা ভালোবাসা দেখে আমি আহ্লাদে কেঁদে ওকে জড়িয়ে ধরি। বুকে কিল দিয়ে আহ্লাদী গলায় বলি,
" তুমি আসলে একটা বদমাইশ লোক।
আমার কথায় হিমু একগাল হেসে বলে,
" জানি তো। প্রতিদিন তো এটায় শুনি।
"জ্যোৎস্না রাতে ঘর ঢিঙিয়ে তোমায় আমি দেখেছি
তোমার গায়ে জ্যোৎস্নার আলো,
দেখে হিংসায় আমি জ্বলেছি। "
হিমায়াত লাইনগুলো বলার সময় আমি ওর বুকে মুখ গুজে রাখি। তার বুকে সে এতো ভালোবাসা বন্ধি করে রেখেছে। আমায় বুঝতে অবধি দেইনা। তার সে ভালোবাসা যেন সে আমায় উপলব্ধি করাচ্ছে নতুন করে। তার সত্ত্বার সাথে আমায় নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।
এই একবছর সে আমায় অনেক পরিবর্তন করেছে। সব আমার ভালো পরিবর্তন। আমার বাজে অভ্যাস ত্যাগ করিয়েছে। আমায় সংসারী হতে সাহায্য করেছে। ম্যাচিউরিটি আনতে সাহায্য করেছে। হয়তো তার নরম স্বভাবে হতোনা। তাই সে শামুকের মতো তার নরম মনটা খোলসে আবদ্ধ করে তার শামুকের শক্ত আবরণটা দেখিয়েছে। আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ। কারণ সে আমার শত ভুল মাফ করে নিজের করে আগলে রেখেছে। তবুও মাঝে মাঝে মিছে মিছে তার উপর রাগ করি। সে রাগের কোন মানে হয়না তবুও। বিনা কারণে রাগ বুঝে সে কিন্তু সে তা ইনজয় করে ব্যাপারটা। হয়তো ওর জায়গায় অন্য কেউ হলে বলতো ন্যাকামো। এই মানুষটার মতো করে আর কেউ হয়তো আমায় আগলে রাখতোনা। আমায় ভালোবাসতোনা।
"(সমাপ্ত)"